লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দিনগুলো
ভাবলে অবাক লাগে যে এমন একটা সময় ছিল যখন আমি লতা মঙ্গেশকরের গলা শুনলে দুকানে আঙ্গুল দিতাম। তখন আমি সদ্য আই আই টি কানপুরে ফেরত গেছি, M.Sc. পড়তে। কলকাতা বিচ্ছেদের বেদনা তখন দগদগে, তায় আবার নতুন পরিবেশে পড়ার চাপ, পটল মনে করে টিন্ডা খাবার স্বপ্নভঙ্গ - এই সবের মাঝে হঠাৎ উপদ্রব পেছনের নানকারী গ্রাম থেকে সন্ধ্যে হলেই দিল তো পাগল হ্যায় সিনেমার গান মাইক থেকে সজোরে মাঠ উজিয়ে একদম জানান দিয়ে কর্ণকুহরে প্রবেশ। আর প্রবেশ বলে প্রবেশ, তার সঙ্গে শাদীর সানাই, বর কনে সব পক্ষের চেঁচানি - সে এক সাংঘাতিক পাঁচন। কিন্তু মুশকিল হল যে এই গানগুলো যখন লতা গেয়েছিলেন, গলার অবস্থা শুধু পড়ন্ত নয়, একেবারে ডুবন্ত। এক ভয়ানক মেটালিক আন্ডারটোন গলার মধ্যে আর সেই গান এক সন্ধেতে একবার নয়, বার বার শুনে আমার বিবমিষা ওঠবার জোগাড়।
সমগ্র দেশের সঙ্গীতের সঙ্গে যিনি নকশী কাঁথার মতন জড়িয়ে গেছেন, আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এক একটা অনন্য গল্প, তা আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব। সত্যি কথা বলতে কি, আমি কখনো লতার অনুরক্ত ভক্ত ছিলাম না। এখন পেছন ফিরে দেখলে মনে হয় তার কারণ হয় তো এই যে তাঁর গান রেডিও, টিভি, রেকর্ড, পাশের বাড়ির জানলা, এত জায়গা থেকে এসে আমার সত্তার অংশ হয়ে গেছিল যে আলাদা করে খেয়াল করবার অবকাশ হয় নি। আজ সারাদিন আমার খুব কাছের বন্ধুদের অনেককেই বলতে শুনেছি তাদের প্রিয় লতার গান, তাতে হিন্দি সিনেমার গানই বেশি, দেশভক্তির গানও রয়েছে কিন্তু তাও হিন্দিতেই। আমার কিন্তু গান শোনবার সুদূরতম স্মৃতি মশারির মধ্যে আধো ঘুমে জানলা থেকে বাইরে চেয়ে রয়েছি, বাইরে এক ফালি চাঁদ দেখা দিয়েছে আর কোথা থেকে ভেসে আসছে "আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরে তারার পানে চেয়ে, আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে, ব্যাথার বাদলে যায় ছেয়ে"। গানের অন্তর্নিহিত বিষাদের ভাব বোধগম্য হত না একদমই, তবে ঘুমের চাদর অব্যর্থ নেমে আসতো রাতের অন্ধকারে।
আবার বাবা ছিল ক্লাসিক মধ্যবিত্ত। গান শোনবার ব্যাপারে উন্নাসিক। তাই আমাদের বাড়িতে ছিল বিলেতের Garrard কোম্পানির এক রেকর্ড চেঞ্জার। কিন্তু লতা মঙ্গেশকরের রেকর্ড ছিল সব বাংলা এবং তাও সব ৭৮ আরপিএম। তার মধ্যে একটা ছিল সাত ভাই চম্পা সিনেমার দুটি গান, এপিঠ ওপিঠ। আমাদের বাড়িতে টেপ শোনবার চল ছিল না। জাপানি এক টেপ রেকর্ডার বাক্সবন্দি হয়ে পরে থাকতো আলমারীর মাথায়। কিন্তু কখনো সখনো নামানো হলে শোনা যেত লতার লাইভ ইন রয়্যাল আলবার্ট হল এর রেকর্ড করা ক্যাসেট। সেই বোধ হয় প্রথম লতার গাওয়া হিন্দী গানের অনুপ্রবেশ আমার জীবনে। তার আরও পরে ভেবেছি বৈজু বাউরা সিনেমার ৩৩১/৩ রেকর্ড দেখে যে দোলের আগে চিত্রহারে শোলে সিনেমাতে যাঁর গান দেখবার জন্যে প্রাণ আঁকুপাঁকু করে, তিনিই আবার আমীর খান, ডি ভি পালুসকার এর মতন গায়কদের সঙ্গে একই ক্ষেত্রে জায়গা করে নিতে পারেন কেমন করে।
সময়ের নিয়মেই আমার খোঁজা গান সরে গেছে লতার কাছ থেকে, কখনো অজানায় পাশ কাটিয়ে। বন্ধু বান্ধব দাদা কাকা মামাদের সঙ্গে আলোচনায় মেনে নিয়েছি যে লতা মঙ্গেশকর এক নক্ষত্র কিন্তু তাঁকে জানবার চার অনুভব করিনি কখনো। কিন্তু আমার অজান্তেই পাশের ঘরে সমস্ত ধর্মাচরণ থেকে সরে থাকা আমার বড়মামু রেকর্ডে বাজিয়ে চলেছে "রামনাম কা গুন্ গান করিয়ে ", রাতের শেষ প্রহরে আমি বাজিয়েছি "বিতি না বিতায়ি রয়না" আর শিহরিত হয়েছি আর ডি বর্মণের সুরের জাল বুননের নিপুণতায় কিন্তু তাও আলাদা করে গায়িকার প্রত্যেক বাঁকে নির্ভুল স্বরক্ষেপণ নজরে আসে নি। লজ্জার মাথা খেয়ে বলতে হয় যে সেই অজ্ঞান ভাঙে শেষমেশ কলেজে ঢুকে।
তখন খান কয়েক টিউশনি করে সামান্য অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা গজিয়েছে,সব সময় বড়মামু নির্ভরতার আপাতঃ প্রস্থান ঘটেছে, এমন সময় একদিন নজরে পড়ল এইচ এম ভি কোম্পানীর চারটে ক্যাসেটের আর ডি বর্মন গোল্ডেন কালেকশন। ১৮০ টাকা দাম, এক একটা ৪৫ টাকা। হিন্দি গানের ক্যাসেটের তুলনায় সেই সময়ও বেশ বেশি। গরুর জাবর কাটবার মতন বার ছয়েক দোকানে গিয়ে এপিঠ ওপিঠ দেখবার পর দোকানের মালিকের বন্ধুত্বপূর্ণ চাহনি যখন কড়া হতে শুরু করেছে তখন কড়কড়ে টাকা দিয়ে কিনতে বাধ্য হলাম। এক গ্রীষ্মের রাতে জানলা খুলে হু হু হওয়ার মধ্যে তার একটা চালিয়ে সেই প্রথম শুনলাম "সিলি হাওয়া ছুঁ গ্যায়ি "। তখনো অবধি আর ডির সিনেমার গান মানেই আশা বা অন্য কেউ কিন্তু সে কেউ যে কে তা তলিয়ে ভাবার প্রয়োজন বোধ হয় নি। এই প্রথম মনে হল যে এই গান পৃথিবীর আর কারুর পক্ষেই বোধ হয় গাওয়া সম্ভব নয়, আদি অনন্ত কোনো কালেই নয় । সেই প্রথম আমার লতা মঙ্গেশকরের অন্বেষনের শুরু , তা চলছে এখনো। এক বন্ধুবর অংশুমান চক্রবর্তীর সঙ্গে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পরিচয়ের দিন কয়েকের মধ্যেই আবিষ্কার করেছিলাম যে , একে অন্যের অজান্তেই আমরা প্রায় একই সময় ওই একই গোল্ডেন কালেকশন কিনেছিলাম আর ওই একই গান আবিষ্কার করেছিলাম জীবনের একই সন্ধিক্ষণে।
এক রবিবার আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে অপর্ণা সেনের "নির্জন দ্বীপের ছবি" লেখা পড়ে চমকিত হয়েছিলাম। তার অনেক পরে আমার পোস্টডক উপদেষ্টা শিখিয়েছিলেন সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে এই বলে যে "ইফ সামওয়ান হেল্ড এ গান টু ইওর হেড , হোয়াট উড ইউ সে "। বাঙালি মধ্যবিত্ত অনুশাসনে বহুপ্রেমের স্থান বিশেষ নেই, তাই মাঝে মধ্যেই নিজেকে আর কাছের বন্ধুদের এই বলে জ্বালাই যে "অমুকের যদি একটা গান /বাজনা desert island নিয়ে যেতে হয়, কোনটা নিবি ?" লতা মঙ্গেশকর জনজীবন থেকে সরে যাবার পর মাঝে মধ্যেই যখন ভয় হত যে খবরটা বোধ হয় হয় এই এল বলে, নিজেকে শুধোতুম, "কোন গানটা নেবে ?" উত্তর আসতো "কেশরীয়া বালমা"। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, রাশিবিজ্ঞান বলছে এটাই আমার উত্তর। পড়ন্ত বেলায় গাওয়া এই গান যে কেন আমার এতো কাছের তার নির্ভুল উত্তর দেবার কাছেপিঠেও বিজ্ঞান এখনো অগ্রসর হয় নি। এই গান শুনলেই আমার মাথার মধ্যে ভেসে ওঠে পড়ন্ত সন্ধ্যের আলোয় রাজস্থানের মরুভূমি তে উস্কোখুস্কো চুলে বিরহিনী রাধা নিরলস খুঁজছেন প্রেমিকের আবছায়া। সেই রাধার মুখ আমি দেখি নি, সে চেষ্টা করলেই সে মুখ লতা মঙ্গেশকর না ডিম্পল কাপাডিয়ার না ক্যালেন্ডারে দেখা রাধার , তার সন্ধান পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বিরহিনী দূরে চলে যান। আমার সম্বল গানই শেষমেশ পড়ে থাকে।
আমার প্রেমের লতা তাই "আয়েগা আনেওয়ালা" র লতা নন, "লাগে যা গালে" র অধরদংশিনী লতাও নন, আমার প্রেমের লতা পড়ন্ত বেলার লতা যিনি গেয়েছেন "ফির কিশি শাখ নে" আর "ইস দিল মে বসকর দেখো তো " আমার প্রেমের লতা শরীরী নয় , cerebral . কিন্তু সে তো একান্ত আমার , আর আমাদের প্রত্যেকের লতা মঙ্গেশকরই তাই অনন্যা। লতার চলে যাওয়া তাই শুধু তাঁর যাওয়া নয়, একটা সময়ের চলে যাওয়া। সেই সময়ের সঙ্গে মিশে আছে আমার বাবার টেপ রেকর্ডার থেকে ভেসে আসা আলবার্ট হলের লাইভ রেকর্ডিংয়ের গান, আমার বড়মামুর ফিলিপ্স HiQ International থেকে লতার ভজন। এঁরা চলে গেছেন আগেই , শেষ সুবাসটুকুও লতা নিয়ে চলে গেলেন।
গতকাল থেকে লতার ছবিতে ফেসবুক ছেয়ে গেছে। তাই ওঁর ছবি আর দিলাম না এই লেখাটার সঙ্গে। আমার বড়মামুর কাছে একটা এল পি ছিল "লতা মঙ্গেশকর সিঙস ফর গালিব", তার ছবিটা খুঁজে দিলাম। তাঁর অগ্রজ উপমহাদেশের আর এক দিশারীর মতন মর্ত্যের বাঁধন চুকিয়ে লতাও এখন চলেছেন সঙ্গীতের বাতি হাতে। স্বর্গের দরকার কি ? যেখানে থেমে তিনি গান জুড়বেন , স্বর্গের দোর তো সেখানেই।
No comments:
Post a Comment