Monday, February 7, 2022

 নিউয়র্ক - স্মৃতি রোমন্থন, সন ২০১১


একদিন ভোরে বসন্তের ঘুম ভেঙে যায়। সকালে উঠে জানলার দুপাটি  ঠেলে দেখি আলতো ঠান্ডা হাওয়া গা ছুঁয়ে চলে গেলো, গায়ে তেমন লাগলো না।  ঈশান এখনো ঘুমন্ত। জানলার বাইরে দেখি কুইন্সবোরো ব্রিজের মাথায় বসে খানসাহেব মেজাজে সিন্ধি ভৈরবী ধরেছেন। পাশে জাকির সাহেব, মুখে আলতো হাসি। খানসাহেবের  মেজাজটা ধরেছেন। ম্যানহাটানের রাস্তায় গাড়ির ভিড় তেমন নেই. খানসাহেবের  সেতার ছড়িয়ে যাচ্ছে দূরে, দিগন্তের ওপারে। এক দমকায় মনটা হালকা হয়ে ওঠে। চোখ তুলে দেখি দেশপ্রিয় পার্কের ওপারে আলো ফুটছে আকাশে। "ফেব্রুয়ারী কি চলে এল ?" আপনমনে শুধোই নিজেকে। এলিয়ট সাহেব বলেছিলেন "April is the  cruellest  month "। আমার তো মনে হয়, ফেব্রুয়ারীর মতন নিষ্ঠুর মাস আর হয় না - কখন আসে, কখন যায়, বুঝতেই পারা যায় না। ঈশানের কান্নায় চটক কাটে। এই বার পরবাসীর দিনের দমকল চলতে শুরু করবে। 


ঈশানের সারা দিনের দায়িত্ত্বের মধ্যে শুধু সকাল আর গভীর রাত্রিটাই আমার। বসন্তের ঠাহর যে তার খুব একটা কিছু হয়েছে বোঝা গেলো না। সকালের দুধ আর সিরিয়াল খেতে ঠিক তেমনটি ৪৫ মিনিট লাগলো। ভীরু মধ্যবিত্ত বাঙালি বাপের  মতন আমি এই সকালেও তার গায়ে মোটা একটা জ্যাকেট চাপিয়ে দিলুম। সুজাতার তুলনায় আমার সকালটা অনেক সরল। রাস্তা পার হয়ে ক্যাম্পাস এর মধ্যে ডে কেয়ার। সেখানে তাকে অর্পণ করেই আমার দায়িত্ব থেকে মুক্তি। রাস্তায় যেতে যেতে ঈশান এর ইতালীয় বান্ধবী র সঙ্গে দেখা। তার মনেও  বসন্তের ছোঁয়াচ লেগেছে। শুধুমাত্র গোলাপি স্কার্ট আর টি-শার্ট  পরিহিতা বান্ধবী কে দেখে আমার পুত্রের মনেও রং লাগে। সে জ্যাকেট টেনে ছুঁড়ে ফেলে তার সঙ্গে দৌড় লাগায়। দুরু দুরু বক্ষে আমি তার পেছন পেছন নিউইয়র্কের  রাস্তা পার হই - ফুল ফুটুক কি না ফুটুক, আজ বসন্ত। 


ল্যাবের মধ্যে ঢুকে বসন্ত প্রমাদ গোনে। বিজ্ঞান এর জগতে বসন্তের স্থান নেই. সব দিনই কঠিন কঠোর শীত.  ল্যাবে  ঢোকবার মুখে হঠাৎ অনেক পুরোনো একটা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ঠাহর হয় যে আমার নোবেলজয়ী অভিবাবক এর এর কমলালেবু গাছে মুকুল এসেছে। ঠান্ডার জন্যে ল্যাবের ঠিক বাইরে , বিল্ডিং এর মধ্যে রাখা ছিল, কিন্তু তাতে কি ? ঠান্ডার পর্দা ভেদ করে যেমন  বসন্তের আগমন, ঠিক তেমনি প্রকৃতির নিয়মে ম্যানহাটানের ওপর তার মনমাতানো গন্ধ নিয়ে কমলালেবুর মুকুল হাজির হয়েছে আমার ছোটবেলার স্মৃতির সম্ভার নিয়ে, দরজায় টোকা মেরে। কমললেবুর ফুলের গন্ধের সঙ্গে কলকাতার কোন গন্ধের মিল  ভাবতে ভাবতে আমি ল্যাব এ ঢুকে পড়ি - শীত গ্রীষ্ম বসন্ত মিশে যায়  দৈনন্দিন কাজের টানাপোড়েনে। 


দুপুরবেলায় খেতে যাবার জন্যে বাড়ির দিক এ পা বাড়িয়ে দিয়ে খেয়াল হয় যে শীতবুড়োর যাবার পালা আগতপ্রায়। এখন আর ঠান্ডা প্রায় নেই বললেই চলে. রাস্তায় পা বাড়িয়ে খেয়াল হয় যে হাতে বিন্দু বিন্দু  ঘাম জমেছে।  গরমের মধ্যে  মাথার প্রান্ত থেকে আঙ্গুল অবধি বওয়া ঘাম নয় , শীত এর সকাল এ শিশির বিন্দু র মতন জমা ঘাম, যা দেশে  বইমেলা যাবার সময় বাস এ উঠে প্রথম টের পেতুম। আচ্ছা, আজকে বইমেলা র শেষ দিন না কলকাতায় ? পৃথিবীর সব জায়গায় কি একই  সঙ্গে বসন্ত আসে ? গেট খুলে রাস্তায় বার হবার সময় হঠাৎ মনে হয় -" এমন দিনে তারে বলা যায় ", কিন্তু বলেছিলুম কি ? 


বাড়িতে ফিরে স্যান্ডউইচ বানাতে বানাতে শুনি খোলা জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসছে ভীমপলাশ্রী। উঁকি মেরে দেখি খানসাহেব রাগত মুখ করে বাজাচ্ছেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করেন - গত সংখ্যার দেশে  নীলাক্ষ লিখেছিল  না, যে আমার দিন শেষ ? ডাক দেখি কাকে ডেকে আনবি। "ম্যায় বিলায়েত  খান বোল রাহা হুঁ, হ্যায় কোই সামনে আনেওয়ালা ?" মন চায় খানসাহেবের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে ওঁকে আশ্বস্ত করতে কিন্তু সে ধৃষ্টতা এ অধমের সাহসে কুলোয় না।   আনমনে খোলা জানলার সামনে বসে খানসাহেবের বাজনা শুনি আর ভাবি এমন একটা দিনের জন্যে কলকাতাবাসী কি না করতে পারতো। ঠিক এমন একটা দিনের জন্যে অপেক্ষা করে থাকে কলকাতাবাসী সারা বছর, ঠিক এমন একটা দুপুরে ব্রাহ্মমুহূর্তে বইমেলা প্রাঙ্গনে  ফিশ ফ্রাই খেতে খেতে সঙ্গিনীর চোখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড   ধরা দেয়, ভিড়ের ধাক্কা খেতে খেতে বসন্তের নির্ভুল অস্ত্র সানায় বুকের ভেতর - ফুল ফুটুক কি না ফুটুক, আজ বসন্ত। 


পরবাসী  জীবনের ভার ছাড়ানো বড়ো দায় - আজকে যেতে হবে জ্যাকসন হাইটস এ বাজার করতে। সময়ের তাল ভুলে আজ যাবার সময় বাস ধরি, মেট্রো রেলের  বদলে।  কুইন্সবোরো ব্রিজ পার হবার সময় শুনি খানসাহেব সাঁজ সারাবালী ধরেছেন খোশ মেজাজে। দুপুরের রাগত মেজাজ উধাও, ধীর লয়ে আলাপ শুরু করেছেন, এখন বাজনা চলবে অনেকক্ষণ। আজ নিউয়র্কবাসীর মনেও রং লেগেছে, বাস ড্রাইভার হালকা  মেজাজে চালিযে নিয়ে যায়  জ্যাকসন হাইটস এর পানে। বাস থেকে নেমে দেখি গোটা জ্যাকসন হাইটসে  উপমহাদেশের লোক বসন্ত উদযাপনে নেমে পড়েছে - জ্যাকেট নেই কারুর গায়ে। রেস্তোরাঁতে, দোকানপাটে, পানের দোকানে, মায়ে মুদিখানার দোকানে লোকের মনে রং লেগেছে আজ। বয়স্ক সর্দারজী হালকা গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে ক্রেডিট কার্ড চালিয়ে দেন যন্ত্রের মধ্যে - "সব কুছ ঠিক তো হয় বেটা ?" আমি ঘাড় নাড়ি , তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে, ঈশানের রাত্রের ঘুম এর দায় আমার ঘাড়ে ! 


ফেরবার সময় খানসাহেব এর দেখা মেলে না, বাজনা বোধ হয় অনেকক্ষন শেষ হয়েছে, নির্ঘাত রাত্রের মতন ঘুমোতে গেছেন। আমি বাজার রেখে রাত্রের খাওয়া শেষ করে আবার ল্যাবের দিকেও রওনা হই. দিনের হালকা কবোষ্ণ ভাব উধাও, শীতবুড়ো  আবার কামড় বসাবে কি না ঠাহর করতে পারছে না। ম্যানহাটানের রাস্তা আস্তে আস্তে হালকা হবার দিকে - ল্যাবে এখনো অনেক কাজ পড়ে, বিজ্ঞান কি আর বসন্তের কদর করে ? 


রাত্রিবেলা ল্যাবের  মেজাজ পাল্টে যায়, সবাই থাকে না, দিনের খোলস ভেদ করে হঠাৎ সহকর্মীর মনের কথা বাইরে চলে আসে।  অনেক অনেক দিন আগে উচ্চাকাঙ্ক্ষাতে ভর করে চলে এসেছিলাম আমরা সবাই সাগরপারে, বসন্ত সে কথা মনে করিয়ে দেয় সবাইকে। জানলার বাইরে অন্ধকার ভেদ করে কুইন্সবোরো  ব্রিজের বাতিস্তম্ভের আলো দেখতে দেখতে আমি ভাবি আমার চীনে সহকর্মীর শহরেও  বইমেলা হয় কি না।  বসন্ত বোধ হয় বিজ্ঞানের গায়েও ছোঁওয়া লাগিয়েছে দিনের শেষে, তাই সব শ্রমই বিফলে যায় না, পরিশ্রান্ত দিনের শেষে  পড়ে  পাওয়া চোদ্দ আনা কিছু বাকি থাকে, তাই নিয়েই ল্যাব বন্ধ করে পাড়ি দি, রাস্তা পার হয়ে বাড়ির দিকে। 


বাড়ির চারিদিক স্তব্ধ চুপচাপ, ঘুমন্ত ঈশানের মুখে রাস্তার আলো পড়ে  পিছলে যাচ্ছে। শেষ বারের মতন জানলার কাছে এসে বন্ধ করার আগে হঠাৎ শুনি সেই আওয়াজ। মুখ বাড়িয়ে দেখি খানসাহেব এসে বসেছেন ব্রিজের মাথায়, ঠিক ছোটবেলায় দেখা এলপি রেকর্ডের ছবির  মতন, পিঠে আলতো করে ফেলা একটা কালো শাল, দৃষ্টি আকাশ আর সেতারের মাঝে কোথায় নিবদ্ধ, খানসাহেব দরবারী তে আলাপ ধরেছেন। একটু দূরে শঙ্কর  ঘোষ এসে বসেছেন, চুপ করে বসে শুনছেন খানসাহেব এর আলাপ। ম্যানহাটানের রাস্তায় সোনালী আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি শেষ রাতের সফর সেরে ফিরছে কুলায় আর দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ছড়িয়ে  যাচ্ছে খানসাহেবের  বাজনা।  ঠিক ঠাহর হয় না দূরে শাহজাহান আর মুমতাজমহল এসে বসেছেন কি না। আমার খুব ইচ্ছে হয় একবার খানসাহেবকে  জিজ্ঞেস করি  - "এতো দুঃখ কোথায় রাখেন খানসাহেব ? খালি কি বাজনার সময়তেই বার হয় ?" কিন্তু এখন কথা বলবার সময় নয় - খানসাহেবের বাজনা শুনে ঈশান ঘুমের মধ্যে খিলখিলিয়ে হেসে পাশ ফেরে। তা দেখতে দেখতে শ্ৰান্ত আমি ঘুমিয়ে পড়ি - কাল বসন্তের দ্বিতীয় দিন !




লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দিনগুলো 
ভাবলে অবাক লাগে যে এমন একটা সময় ছিল যখন আমি লতা মঙ্গেশকরের গলা শুনলে দুকানে আঙ্গুল দিতাম। তখন আমি সদ্য আই আই টি কানপুরে ফেরত গেছি, M.Sc. পড়তে। কলকাতা বিচ্ছেদের বেদনা তখন দগদগে, তায় আবার নতুন পরিবেশে পড়ার চাপ, পটল মনে করে টিন্ডা খাবার স্বপ্নভঙ্গ - এই সবের মাঝে হঠাৎ উপদ্রব পেছনের নানকারী গ্রাম থেকে সন্ধ্যে হলেই দিল তো পাগল হ্যায় সিনেমার গান মাইক থেকে সজোরে মাঠ উজিয়ে একদম জানান দিয়ে কর্ণকুহরে প্রবেশ। আর প্রবেশ বলে প্রবেশ, তার সঙ্গে শাদীর সানাই, বর কনে সব পক্ষের চেঁচানি - সে এক সাংঘাতিক পাঁচন। কিন্তু মুশকিল হল যে এই গানগুলো যখন লতা গেয়েছিলেন, গলার অবস্থা শুধু পড়ন্ত নয়, একেবারে ডুবন্ত। এক ভয়ানক মেটালিক আন্ডারটোন গলার মধ্যে আর সেই গান এক সন্ধেতে একবার নয়, বার বার শুনে আমার বিবমিষা ওঠবার জোগাড়।
সমগ্র দেশের সঙ্গীতের সঙ্গে যিনি নকশী কাঁথার মতন জড়িয়ে গেছেন, আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এক একটা অনন্য গল্প, তা আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব। সত্যি কথা বলতে কি, আমি কখনো লতার অনুরক্ত ভক্ত ছিলাম না। এখন পেছন ফিরে দেখলে মনে হয় তার কারণ হয় তো এই যে তাঁর গান রেডিও, টিভি, রেকর্ড, পাশের বাড়ির জানলা, এত জায়গা থেকে এসে আমার সত্তার অংশ হয়ে গেছিল যে আলাদা করে খেয়াল করবার অবকাশ হয় নি। আজ সারাদিন আমার খুব কাছের বন্ধুদের অনেককেই বলতে শুনেছি তাদের প্রিয় লতার গান, তাতে হিন্দি সিনেমার গানই বেশি, দেশভক্তির গানও রয়েছে কিন্তু তাও হিন্দিতেই। আমার কিন্তু গান শোনবার সুদূরতম স্মৃতি মশারির মধ্যে আধো ঘুমে জানলা থেকে বাইরে চেয়ে রয়েছি, বাইরে এক ফালি চাঁদ দেখা দিয়েছে আর কোথা থেকে ভেসে আসছে "আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরে তারার পানে চেয়ে, আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে, ব্যাথার বাদলে যায় ছেয়ে"। গানের অন্তর্নিহিত বিষাদের ভাব বোধগম্য হত না একদমই, তবে ঘুমের চাদর অব্যর্থ নেমে আসতো রাতের অন্ধকারে।  
আবার বাবা ছিল ক্লাসিক মধ্যবিত্ত। গান শোনবার ব্যাপারে উন্নাসিক। তাই আমাদের বাড়িতে ছিল বিলেতের Garrard কোম্পানির এক রেকর্ড চেঞ্জার। কিন্তু লতা মঙ্গেশকরের রেকর্ড ছিল সব বাংলা এবং তাও সব ৭৮ আরপিএম। তার মধ্যে একটা ছিল সাত ভাই চম্পা সিনেমার দুটি গান, এপিঠ ওপিঠ। আমাদের বাড়িতে টেপ শোনবার চল ছিল না। জাপানি এক টেপ রেকর্ডার বাক্সবন্দি হয়ে পরে থাকতো আলমারীর মাথায়। কিন্তু কখনো সখনো নামানো হলে শোনা যেত লতার লাইভ ইন রয়্যাল আলবার্ট হল এর রেকর্ড করা ক্যাসেট। সেই বোধ হয় প্রথম লতার গাওয়া হিন্দী গানের অনুপ্রবেশ আমার জীবনে। তার আরও পরে ভেবেছি বৈজু বাউরা সিনেমার ৩৩১/৩ রেকর্ড দেখে যে দোলের আগে চিত্রহারে শোলে সিনেমাতে যাঁর গান দেখবার জন্যে প্রাণ আঁকুপাঁকু করে, তিনিই আবার আমীর খান, ডি ভি পালুসকার এর মতন গায়কদের সঙ্গে একই ক্ষেত্রে জায়গা করে নিতে পারেন কেমন করে।  
সময়ের নিয়মেই আমার খোঁজা গান সরে গেছে লতার কাছ থেকে, কখনো অজানায় পাশ কাটিয়ে। বন্ধু বান্ধব দাদা কাকা মামাদের সঙ্গে আলোচনায় মেনে নিয়েছি যে লতা মঙ্গেশকর এক নক্ষত্র কিন্তু তাঁকে জানবার চার অনুভব করিনি কখনো। কিন্তু আমার অজান্তেই পাশের ঘরে সমস্ত ধর্মাচরণ থেকে সরে থাকা আমার বড়মামু রেকর্ডে বাজিয়ে চলেছে "রামনাম কা গুন্ গান করিয়ে ", রাতের শেষ প্রহরে আমি বাজিয়েছি "বিতি না বিতায়ি রয়না" আর শিহরিত হয়েছি আর ডি বর্মণের সুরের জাল বুননের নিপুণতায় কিন্তু তাও আলাদা করে গায়িকার প্রত্যেক বাঁকে নির্ভুল স্বরক্ষেপণ নজরে আসে নি। লজ্জার মাথা খেয়ে বলতে হয় যে সেই অজ্ঞান ভাঙে শেষমেশ কলেজে ঢুকে। তখন খান কয়েক টিউশনি করে সামান্য অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা গজিয়েছে,সব সময় বড়মামু নির্ভরতার আপাতঃ প্রস্থান ঘটেছে, এমন সময় একদিন নজরে পড়ল এইচ এম ভি কোম্পানীর চারটে ক্যাসেটের আর ডি বর্মন গোল্ডেন কালেকশন। ১৮০ টাকা দাম, এক একটা ৪৫ টাকা। হিন্দি গানের ক্যাসেটের তুলনায় সেই সময়ও বেশ বেশি। গরুর জাবর কাটবার মতন বার ছয়েক দোকানে গিয়ে এপিঠ ওপিঠ দেখবার পর দোকানের মালিকের বন্ধুত্বপূর্ণ চাহনি যখন কড়া হতে শুরু করেছে তখন কড়কড়ে টাকা দিয়ে কিনতে বাধ্য হলাম। এক গ্রীষ্মের রাতে জানলা খুলে হু হু হওয়ার মধ্যে তার একটা চালিয়ে সেই প্রথম শুনলাম "সিলি হাওয়া ছুঁ গ্যায়ি "। তখনো অবধি আর ডির সিনেমার গান মানেই আশা বা অন্য কেউ কিন্তু সে কেউ যে কে তা তলিয়ে ভাবার প্রয়োজন বোধ হয় নি। এই প্রথম মনে হল যে এই গান পৃথিবীর আর কারুর পক্ষেই বোধ হয় গাওয়া সম্ভব নয়, আদি অনন্ত কোনো কালেই নয় । সেই প্রথম আমার লতা মঙ্গেশকরের অন্বেষনের শুরু , তা চলছে এখনো। এক বন্ধুবর অংশুমান চক্রবর্তীর সঙ্গে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পরিচয়ের দিন কয়েকের মধ্যেই আবিষ্কার করেছিলাম যে , একে অন্যের অজান্তেই আমরা প্রায় একই সময় ওই একই গোল্ডেন কালেকশন কিনেছিলাম আর ওই একই গান আবিষ্কার করেছিলাম জীবনের একই সন্ধিক্ষণে।  
এক রবিবার আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে অপর্ণা সেনের "নির্জন দ্বীপের ছবি" লেখা পড়ে চমকিত হয়েছিলাম। তার অনেক পরে আমার পোস্টডক উপদেষ্টা শিখিয়েছিলেন সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে এই বলে যে "ইফ সামওয়ান হেল্ড এ গান টু ইওর হেড , হোয়াট উড ইউ সে "। বাঙালি মধ্যবিত্ত অনুশাসনে বহুপ্রেমের স্থান বিশেষ নেই, তাই মাঝে মধ্যেই নিজেকে আর কাছের বন্ধুদের এই বলে জ্বালাই যে "অমুকের যদি একটা গান /বাজনা desert island নিয়ে যেতে হয়, কোনটা নিবি ?" লতা মঙ্গেশকর জনজীবন থেকে সরে যাবার পর মাঝে মধ্যেই যখন ভয় হত যে খবরটা বোধ হয় হয় এই এল বলে, নিজেকে শুধোতুম, "কোন গানটা নেবে ?" উত্তর আসতো "কেশরীয়া বালমা"। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, রাশিবিজ্ঞান বলছে এটাই আমার উত্তর। পড়ন্ত বেলায় গাওয়া এই গান যে কেন আমার এতো কাছের তার নির্ভুল উত্তর দেবার কাছেপিঠেও বিজ্ঞান এখনো অগ্রসর হয় নি। এই গান শুনলেই আমার মাথার মধ্যে ভেসে ওঠে পড়ন্ত সন্ধ্যের আলোয় রাজস্থানের মরুভূমি তে উস্কোখুস্কো চুলে বিরহিনী রাধা নিরলস খুঁজছেন প্রেমিকের আবছায়া। সেই রাধার মুখ আমি দেখি নি, সে চেষ্টা করলেই সে মুখ লতা মঙ্গেশকর না ডিম্পল কাপাডিয়ার না ক্যালেন্ডারে দেখা রাধার , তার সন্ধান পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বিরহিনী দূরে চলে যান। আমার সম্বল গানই শেষমেশ পড়ে থাকে।  
আমার প্রেমের লতা তাই "আয়েগা আনেওয়ালা" র লতা নন, "লাগে যা গালে" র অধরদংশিনী লতাও নন, আমার প্রেমের লতা পড়ন্ত বেলার লতা যিনি গেয়েছেন "ফির কিশি শাখ নে" আর "ইস দিল মে বসকর দেখো তো " আমার প্রেমের লতা শরীরী নয় , cerebral . কিন্তু সে তো একান্ত আমার , আর আমাদের প্রত্যেকের লতা মঙ্গেশকরই তাই অনন্যা। লতার চলে যাওয়া তাই শুধু তাঁর যাওয়া নয়, একটা সময়ের চলে যাওয়া। সেই সময়ের সঙ্গে মিশে আছে আমার বাবার টেপ রেকর্ডার থেকে ভেসে আসা আলবার্ট হলের লাইভ রেকর্ডিংয়ের গান, আমার বড়মামুর ফিলিপ্স HiQ International থেকে লতার ভজন। এঁরা চলে গেছেন আগেই , শেষ সুবাসটুকুও লতা নিয়ে চলে গেলেন। গতকাল থেকে লতার ছবিতে ফেসবুক ছেয়ে গেছে। তাই ওঁর ছবি আর দিলাম না এই লেখাটার সঙ্গে। আমার বড়মামুর কাছে একটা এল পি ছিল "লতা মঙ্গেশকর সিঙস ফর গালিব", তার ছবিটা খুঁজে দিলাম। তাঁর অগ্রজ উপমহাদেশের আর এক দিশারীর মতন মর্ত্যের বাঁধন চুকিয়ে লতাও এখন চলেছেন সঙ্গীতের বাতি হাতে। স্বর্গের দরকার কি ? যেখানে থেমে তিনি গান জুড়বেন , স্বর্গের দোর তো সেখানেই।