Saturday, April 30, 2022


গোরো কি না কালো কি

বাপি লাহিড়ীর সংগীতজীবনে একটি সুদির্নিষ্ট বিভাজিকা ছিল। তার দ্বিতীয় অধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের কৈশোরেরও শুরু। সেই সময়ের কলকাতায় গান শোনার অনুরণন ব্যক্তিগত হলেও গানের অধিকার ব্যক্তিসীমিত ছিল না। চায়ের দোকানের রেডিও, ক্যাসেটের দোকানের স্পিকার থেকে গান ভেসে এসে ছড়িয়ে যেত চারিদিকে, মিলে যেত শহরের আওয়াজের সঙ্গে। গান শোনা এখনকার মতো স্মার্টফোন, হেডফোন, স্পটিফাই নির্ভর ছিল না। সেই গানের মধ্যে যেমন অনুপ জলোটার ভজন থাকত, তেমন সন্ধ্যা মুখোর গানও থাকত। সে গান না শুনে উপায় ছিল না এবং কখনো রাসবিহারী এভিনিউ ধরে হাঁটবো কিন্তু আমার পছন্দের গান শুনবো, চারিদিকের শব্দ বাদ দিয়ে, এমন ভাবনা মাথায়ও আসে নি। জনপ্রিয়তার লড়াইয়ে প্রত্যেক বছরের বাংলা হিন্দি সিনেমা, আধুনিক গান মায় রবীন্দ্রসংগীতের নানান ক্যাসেটের মধ্যে বিজেতা কে, তার অঘোষিত ফল অনিবার্য জানা যেত দুর্গাপুজো এলে। পুজো তখন শুরু হতো সপ্তমীর সকালেই। কিন্তু ষষ্ঠীর বিকেল থেকে প্যান্ডেল প্যান্ডেলে হাতেগোনা খানকয়েক ক্যাসেটের গানই শহর জুড়ে বাজত। আমার প্রত্যেক বছর পুজোর স্মৃতির সঙ্গে তাই এই গানগুলো ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে। সেই রকমই এক পুজো জুড়ে ছিল বাপি লাহিড়ীর সংগীতজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের এক সিনেমার গান - ডিস্কো ড্যান্সার।

পুজোর দিনগুলোতে সকাল বেলা নতুন ভাঁজভাঙা হাফ প্যান্ট আর কড়কড়ে জামা পড়ে ক্যাপ ফাটানো থেকে রাত্রিবেলা বাবা মার হাত ধরে ভিড় ঠেলে প্রতিমা দেখা, সব কিছুর মধ্যেই এই গানগুলো বাজত ক্লান্তিহীন। সব প্যান্ডেলের প্রতিমা বিজয়ার দিন বিসর্জন যেত না। তাই একাদশীর দিন থেকে গান কমে গেলেও একদম থেমে যেত না। পুজো শেষ হবার আগ্রাসী মনখারাপের ওপর এদিক ওদিক থেকে হঠাৎ ভেসে আসা গান প্রলেপ বিশেষ ছিল। বাপি লাহিড়ী চলে যাবার পর সেই গানগুলো বহুযুগ পর শুনতে শুনতে একটা গানের স্মৃতি বিশেষ করে চাড়া দিয়ে উঠলো - গোরো কি না কালো কি , দুনিয়া হ্যায় দিলওয়ালো কি। বাপি লাহিড়ী কি পুজোর পর চারতলার ঘরে বসে রাস্তার ম্লান আলো দেখতে দেখতে এই গানের সুর দিয়েছিলেন ?

লতা মঙ্গেশকর চলে যাবার পর স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আমাদের বাড়ির রেকর্ড চেঞ্জারের কথা লিখেছিলাম। কিন্তু রেকর্ড কেনবার ব্যাপারে আমার বাবা বেশ বিশুদ্ধবাদী ছিল। নিসার হোসেন খাঁর এল পি ছিল, বৈজু বাওরারও কিন্তু ৭০ দশকের হিন্দি সিনেমার গানের হাতে গোনা খানকয়েক রেকর্ড ছিল, তও ৪৫ আর পি এম। আর ডির পরিচয় সিনেমার এদিকে আর তা অগ্রসর হয় নি। তার মধ্যে হঠাৎ করে একদিন এসে পড়ল বাপির সুর দেওয়া আরমান সিনেমার একটা ৪৫ আর পি এম। আমাদের রেকর্ডের বাক্সের মধ্যে তার ঘন লাল রঙের মোড়ক আর তার ওপর নৃত্যরতার ছবি পুজোর নৈবেদ্যের ওপর মাছের আঁশের মতন শোভা পেত। প্রথম যেদিন সেই রেকর্ড চালিয়ে স্টাইলাসের পিন তার ওপর বসালাম, আর নীল রং এর মোটা কাপড়ে মোড়া স্পিকারের ওদিক থেকে ভেসে এলো রাম্বা হো হো, সেই ধৃষ্টতা যে আমার না সেই স্পিকারের আর সে ঘটনা বাস্তব না পরাবাস্তব তা বোঝবার জন্যে আমি নিজের গায়ে চিমটি কাটবো না স্পিকারের , সেই ধন্দ কাটতে গানটাই শেষ হয়ে গেছিল। গরমের ছুটিতে জামশেদপুর থেকে আমার পিসীরা যখন আসত, কিছুদিন আমাদের বাড়ীতে আর বাকিদিন আমার কাকার বাড়িতে থাকত। পিসতুতো ভাই আর দিদিদের মন মজানোর জন্যে বৈজু বাওরা বিশেষ কাজে আসত না। আমার হাতে তখন অস্ত্র বলতে ছিল একমাত্র সেই আরমান সিনেমার ৪৫ আর পি এম।

বাপি লাহিড়ীর প্রথম জীবনের সুর দেওয়া গান যখন পরে শুনেছি - চলতে চলতে , প্যার মাঙ্গা হ্যায় তুমহি সে , আর অকস্মাৎ সুরকারের নাম আবিষ্কার করে চমৎকৃত হয়েছি, বাপির সংগীতজীবনের এই বিভাজনের কথা বিশেষ করে মনে হয়েছে। আমি যেরকম আর ডির অনুরক্ত ভক্ত, বাপির তেমন অবশ্যই নই। কিন্তু তার হয়ত একটা কারণ জনজীবনে বাপি এই প্রথম পর্যায় ছেড়ে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে গেছিলেন, সোনার গয়না আর কালো চশমা পরে। মঞ্চে অযাচিতে মোটা দাগের কৌতুকের শিকার হয়েছেন , নিজের নামের উচ্চারণ নিয়ে নিজেই মজা করেছেন, সাংগীতিক সমীহ আদায় করবার তোয়াক্কা করেন নি। কিন্তু এই সবের আড়ালে ব্যক্তি ব্যাপী হয়তো কোথাও হারিয়ে গেছেন। তাঁর দ্বিতীয় অধ্যায় বাজারে যত সফল হয়েছে , প্রথম জীবনের সুরের জালে ফেরবার তাগিদ অনুভব করেন নি। বাড়ি ফিরে চশমা আর গয়না খুলে হারমনিয়াম নিয়ে অগ্রজসম আর ডির ছবির সামনে বসে কি বাপি কখনো মন খারাপ করতেন ?

পুজোর স্মৃতি প্রসঙ্গে আর একটা সিনেমার গানের কথা না বলে কথা শেষ করা যাবে না - বাকি সব অ্যালবাম এক পুজোর বেশি স্থায়ী হত না, নতুন প্রেম এসে পুরোনোকে ঠেলা মেরে সরিয়ে দেয়, তেমনই নতুন পুজোয় নতুন গান শোনা যেত। ব্যতিক্রম, এবং বোধ হয় একমাত্র, বাপি লাহিড়ীর সুরে অমর সঙ্গী সিনেমার গান। পর পর দুই পুজো জুড়ে কলকাতা শহরে ছিল অমর সঙ্গীর গান। লক্ষ্মীপুজো তখন পাড়ায় বেশ টিমটিম করেই হত। আমাদের পাড়াতে দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলেই লক্ষ্মী অধিষ্ঠিতা হতেন কিন্তু পুজোর গান আর একবার পাড়াতে পাড়াতে এক সন্ধ্যার জন্যে হলেও শোনা যেত। আবার তা মিলিয়ে যেত লক্ষ্মীপুজোর শেষে। পুজোর ছুটিতে খেলা সাঙ্গ করে সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসে আচম্বিতে রাস্তার ল্যাম্প পোষ্টের ম্লান আলো আঁধারির মধ্যে দূরে কোথাও থেকে গান ভেসে এসে মনে করিয়ে দিত যে কালীপুজো এখনো বাকি। কালীপুজোতেই শেষ বার পুজোর গান দপ করে জ্বলে উঠতো নিভে যাবার আগে, পুজোর বাজির মতন। স্কুল শুরু হয়ে যেত অনতিপরেই, জীবন এগিয়ে চলতো আপন গতিতে। কিন্তু নতুন বছরে হঠাৎ কখনো বাসে যেতে যেতে যখন শুনেছি অমর সঙ্গীর গান, মন চলে গেছে বিগত পুজোর আনন্দ বিষাদে। বাপি লাহিড়ীর খবর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাখিনি অনেক দিনই, গানও আলাদা করে চালিয়ে শোনা হয় ন্নি। কিন্তু তাঁর চলে যাবার খবর ঠিক সেই বিগত বছরের পুজোর গানের মতন ফিরে নিয়ে গেল কোথায়। আপনাকে আলভিদা বলব কেমন করে, বাপি ?







 No photo description available.